একটি আকর্ষণীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা পরিচালনার যাবতীয় নিয়ম,উপস্থাপকের ভূমিকা, বিতর্কের নিয়ম এবং বিতর্কের সভাপতি, বিতার্কিকদের বক্তব্য ও নমুনা স্ক্রিপ্ট বা বক্তব্য এ ব্লগে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হলো।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উপস্থাপক / সঞ্চালকের উপস্থাপনা-
সুপ্রিয় দর্শক, আপনাদের প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি, সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল কলেজ কর্তৃক আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতার প্রথম রাউন্ডের আজকের অনুষ্ঠান। সাথে আছি আমি খোরশেদ আলম। যে বিষয়টি নিয়ে আজ দুটো দলের মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে তা হচ্ছে “বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ সন্তানের মানসিকতা।”
প্রস্তাবিত বিষয়টির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করবেন- সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ-এর বিতার্কিক দল, বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করবেন- চট্টগ্রাম আইডিয়্যাল স্কুল এন্ড কলেজ-এর বিতার্কিক দল ।
প্রিয় দর্শক, আমি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আজকের বিতার্কিকদের সাথে।
পক্ষ দল- সেন্ট্রাল পাবলিক কলেজের বিতার্কিকরা হলেন-
মো: রিফাত, ইসরাত জাহান এবং তাদের দলনেতা মো: ইয়াছিন।
বিপক্ষ দল- চট্টগ্রাম আইডিয়্যাল স্কুল এন্ড কলেজের বিতার্কিকরা হলেন- মো: রাকিব, তাসমিয়া জাহান মিম ও তাদের দলনেতা মো: ফয়েজ।
এবারে আমরা পরিচিত হবো আজকের বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিচারক প্যানেলের সাথে। আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন- প্রকৌশলী জনাব আনোয়ার পারভেজ-জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দলের দলনেতা ও ফাইনালের শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক।
এবং উপস্থিত আছে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডক্টর সানজিদা ফারহানা-চেয়ারম্যান,নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের মাঝে আরও উপস্থিত হয়েছেন জনাব রফিকুল ইসলাম সিকদার, ব্যাংকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসিম উদ্দিন হল বিতর্ক দলের প্রাক্তন বিতার্কিক।
সম্মানিত বিচারকবৃন্দ যে সকল বিষয়ের উপর বিতার্কিকদের নম্বর প্রদান করবেন তা হলো-
উপস্থাপনা : ৫
ভাষার ব্যবহার ও উচ্চারণ : ৫
তথ্য ও তথ্য পরিবেশনা : ১০
যুক্তি প্রয়োগ ও খণ্ডন : ৫
প্রিয় দর্শক, সবশেষে আমরা পরিচিত হবো আজকের অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতির সাথে তিনি সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা ও বিতর্কের ফলাফল প্রদান করবেন। আমাদের মাঝে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন- বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জনাব সালমা আক্তার, অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এবারে আমি সম্মানিত সভাপতিকে মঞ্চে এসে আসন গ্রহণ করবার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
বিতর্ক অনুষ্ঠানটি শুরুর পূর্বে আসুন আজকের বিতর্ক প্রতিযোগিতার নিয়মগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেই। প্রত্যেক বক্তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য মোট পাঁচ মিনিট সময় পাবেন। এক্ষেত্রে চতুর্থ মিনিটে সর্তক সংকেত এবং পঞ্চম মিনিটে চূড়ান্ত সংকেত দেয়া হবে। এছাড়া প্রত্যেক দল থেকে দলনেতা যুক্তি খণ্ডনের জন্য অতিরিক্ত দুই মিনিট সময় পাবেন। এক্ষেত্রে দেড় মিনিটে সতর্ক সংকেত এবং দুই মিনিটে চূড়ান্ত সংকেত দেয়া হবে।
এবারে আমি আজকের অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতিকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি আজকের বিতর্ক অনুষ্ঠানটি শুরু করবার জন্য।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সভাপতির উপস্থাপনা-
সকলকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানিয়ে শুরু করছি আজকের অনুষ্ঠান। আমরা সরাসরি বিতর্কে চলে যাচ্ছি। প্রথমে আহ্বান জানাচ্ছি পক্ষ দলের প্রথম বিতার্কিককে- সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী মো: রিফাতকে তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য।
পক্ষ দল- প্রথম বিতার্কিক: মো: রিফাত হোসেন।
ধন্যবাদ মাননীয় সভাপতি, “ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্লাটে যায়না দেখা এপার ওপার, নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী, সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।” বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ সন্তানের অবহেলা বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে থাকা এ যেন শত শত বাবা মায়ের আর্তনাদ। মাননীয় সভাপতি, বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী, বিতার্কিক বন্ধুরা এবং উপস্থিত সবাইকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। বিতর্ক চলছে- “বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ সন্তানের মানসিকতা” অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত কারণে আলোচ্য প্রস্তাবনার পক্ষে আমার ও আমার দলের অবস্থান।
মাননীয় সভাপতি, আজকের বিতর্কের বিষয় আমরা চারটি ভাগে সংজ্ঞান করতে পারি। বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়িত্ব পালনে অবহেলা এবং মানসিকতা। বার্ধক্য, বিধবা, বৃদ্ধাবস্থা হচ্ছে মানব জীবনের শেষ ধাপ। এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং ক্রমিক গতিতে এগিয়ে আসা শারীরিক বা দৈহিক ক্ষয়। যার ফলে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মক্ষমতা এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। জাতিসংঘের বিধি অনুযায়ী- বৃদ্ধ ব্যক্তি তারা যাদের বয়স ৬০ বা তার উর্ধ্বে। দায়িত্ব হচ্ছে আপনার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থার অধীনে এমন কিছুর প্রতি দায়ী থাকা যার ভালো-মন্দের জন্য আপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে আর আপনি দায়ী থাকবেন। ডিকশনারির মতে অবহেলা হচ্ছে যত্নের মানদণ্ড অনুশীলনে ব্যর্থতা। প্রদত্ত পরিস্থিতিতে ইচ্ছাকৃতভাবে অসতর্কতা অবলম্বন করাই হচ্ছে অবহেলা ।
অবহেলা আবার তিন ধরনের- সামাজিক, আর্থিক এবং মানসিক। আর মানসিকতা হচ্ছে একজন মানুষ বা গোষ্ঠীর চিন্তাধারার উপায় যা দ্বারা তারা ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হন। মাননীয় সভাপতি statistica.com এর এক জরিপ অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে ৬০ বছরের উর্ধ্বে জীবিত ব্যক্তির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার 22 শতাংশ। বাংলাদেশের স্ট্যাটিসটিকস অনুযায়ী বাংলাদেশে এই হার ৩৭% বৃদ্ধ মা-বাবা। তাদের বেশিরভাগ সময় কাটছে অবহেলায় কোন বৃদ্ধাশ্রমের অবহেলিতভাবে।
বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ, একটু চিন্তা করে দেখুন, ছোটবেলায় যেই বাবা-মা ছিল সন্তানের কাছে সবকিছু। কলেজ এর গণ্ডি পেরোনোর পরই তারা যেন হয়ে যায় অচেনা। সন্তানদের মনে জন্ম দিতে শুরু করে বাবা-মার যত্ন নেওয়া বাড়তি খরচ। স্ত্রীর সাথে বাবা মাকে নিয়ে লেগে থাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ, বড় হয়ে আপনি একজন ভালো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হলেও এসব ঘৃণ্য মানসিকতা নিয়ে কখনো একজন ভাল সন্তান হতে পারবেন না।
মাননীয় সভাপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার সোনার সন্তানদের মানসিকতার চরমপন্থীর জন্যইতো সরকারিভাবে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে বৃদ্ধ পিতা-মাদাদের জন্য দেখাশোনা করার আইন পাস করেছে। যা সন্তানের প্রতি বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়িত্ব নিশ্চিত করে এবং যা অবহেলা আইনত দণ্ডনীয়। বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ, সত্যিকার অর্থেই সন্তানের মানসিকতার জন্য বৃদ্ধ পিতা-মাতারা যদি অবহেলিত না হতো তাহলে কি প্রয়োজন ছিল এসব আইন প্রণয়ন করা বা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার? আশা করি বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ উত্তর দিয়ে যাবেন।
মাননীয় সভাপতি, আমার প্রতিপক্ষ বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে সন্তানের মানসিকতাই মূল কারণ, তাকে ধামাচাপা দিতে চাইলেও তার পারবে না। যে সন্তানের প্রিয় ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্টের ছবি সেই সন্তান বাবা মাকে বাসার বাইরে নিয়ে যেতে লজ্জা বোধ করে? তারা মাদার্স ডে পালন করে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য, মায়ের সাথে একটা সেলফি আপলোড করে এবং পরমুহুর্তেই মাকে বলে যাও কাপড়গুলো ধুয়ে নিয়ে আসো।
বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ সন্তানের জন্যইতো আশি বছরের বৃদ্ধা সামিরান বিবি ছেলেমেয়েদের যত্নের অভাবে ঢাকার আগারগাঁও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামনে বসে থালা হাতে বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করে। প্রতিবেদন- দ্য ডেইলি সান ১০ই জুলাই ২০১৮ কিন্তু প্রতিপক্ষের বক্তা যদি মানসিকতার কঠিন বাস্তবতা থেকে মুখ সরিয়ে অন্য সব গৌণ কারণ নিয়ে আসতে চায় তবে সম্ভবত চোখে পড়বে দারিদ্র্য, শহরায়ণ, একক পরিবারের মতো বিষয়গুলোকে কিন্তু বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার ক্ষেত্রে এসব কেবল গৌণ কারণ, মূল কারণ কখনোই নয়।
কেননা বাংলাদেশের দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী ২১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ যারা কিনা যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা তারা তো অবহেলার সংজ্ঞার বাইরে। অবহেলা হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে কোন বিষয় বা পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করা। বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ বাংলাদেশের বিধান ক্ষমতার সামনে দাড়িয়ে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিশাপ আমরা কি দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর উপর আরোপ করতে পারি? প্রশ্ন রইল। আবার একক পরিবারের খাতিরে কৌশলে নিজের বাবা-মাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আধুনিক সমাজের অত্যাধুনিক আইটি প্রযুক্তি দিয়ে দিনে অন্তত ৫ থেকে ১০ মিনিটের জন্য বাবা-মায়ের খোঁজ নেয়ার মানসিকতা যদি আপনার না থাকে তবে তা ভিন্ন মানসিকতার মাছকে একক পরিবারের শাক দিয়ে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করছেন।
বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ আপনারা সম্ভবত হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (র:) এর ঘটনার কথা ভুলে গিয়েছেন। অসুস্থ মায়ের পাশে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সারারাত। তবুও মাকে ডেকে তুললো না, মা কষ্ট পাবে বলে। আর বর্তমান সমাজের সন্তানেরা নিজের চাকরি ও সাংসারিক জীবনের অযুহাতে নিজেদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে বাসার ভৃত্যে পরিণত করেছে। বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ বৃদ্ধ বাবা-মারা নিঃস্বার্থে নিজেরা না খেয়ে নিজেরদের সন্তানকে খাইয়েছেন। সন্তানের এক বিন্দু ভালোবাসার জন্য দিনের পর দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। জীবনের শেষ ধাপে তারা সন্তানের আর্থিক সহায়তা চান না, চান শুধু এক বিন্দু ভালোবাসা। নিঃসঙ্গতায় সন্তানের মুখে শুনতে চাই মা-বাবার ডাকটুকু। কিন্তু সন্তানেরা তাদের সেই ভালোবাসা দেই না বরং অবহেলায় ফেলে রাখে কোন এক বৃদ্ধাশ্রমে।
অবহেলা শুরুটা এরকমই “কেউ বলে বুড়ো ভাম, কেউ বলে পাজি, কেউ বলে এইবার ব্যাটা মরলেই বাঁচি, ঘরে গুঞ্জন বরাদ্দ ভ্রুকুঞ্চন, দেখলেই মুছে যায় ছেলের হাসি, অপরাধ একটাই জেনে রাখ সব্বাই, আমার বয়স হলো ৮০।” বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ আমি আপনি আমরা কেউই চিরতরুণ নই, আমাদের সবাইকে আসিতে আসিতে হইবে। নিজের জীবনে যখন আপনার সুপ্রতিষ্ঠিত সুশিক্ষিত সন্তান আপনাকে অবহেলায় ফেলে রাখবে বিদ্বাশ্রমের তখন সে অবহেলা জন্য কাকে দায়ী করবেন? এ প্রশ্ন রেখে শেষ করছি আমার বক্তব্য। ধন্যবাদ- মাননীয় সভাপতি, ধন্যবাদ সবাইকে।
বিপক্ষ দল- প্রথম বিতার্কিক: মো: রাকিব।
এ পর্যায়ে আহ্ববান করছি বিপক্ষ দলের প্রথম বিতার্কিক মো: রাকিবকে।
আর্তনাদ, চিৎকার অসহায়ত্বের প্রতিধ্বনি’ উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম মানুষের হাতে নেই হাত। আমি অবাক বৃদ্ধ পিতা-মাতার চোখে দেখে আর্তনাদ। হে মাননীয় সভাপতি এ বিশ্ব ধরায় বৃদ্ধ পিতা-মাতা আজ অবহেলিত এবং নির্যাতিত তাদের নিজ সন্তানদের দ্বারায়। আজ কেনইবা বৃদ্ধ পিতা-মাতারা অবহেলিত, নির্যাতিত ? নির্যাতনের হৃদয়বিদারক করুন পিতা-মাতার জন্যই আজকে আমাদের বিতর্ক।
মাননীয় সভাপতিকে ধন্যবাদ জানায় আমাকে এ মহান মঞ্চে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেয়ার জন্য। আজকের বিতর্কের বিষয় নির্ধারিত হয়েছে “বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ সন্তানের মানসিকতা।” বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আমি এবং আমার দল এই বিষয়টির বিপক্ষে অবস্থান করছি অর্থাৎ মাননীয় সভাপতি, পক্ষ দল আজকের বিতর্কের বিষয়ে যে বিষয়টি টেনে এনেছেন সেটি হচ্ছে বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার প্রতি অবহেলার মূল কারণ হিসেবে তারা সামনে এনেছেন সন্তানের মানসিকতা।
এই জায়গাটিতেই আজকে আমাদের বিরোধিতা নয় বরং সন্তানের সুশিক্ষার অভাব বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ। ইতোমধ্যে পক্ষ দলের প্রথম বক্তা তার নির্ধারিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। মাননীয় সভাপতি, আমি তার পুরো বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনলাম এবং প্রত্যাশা করেছিলাম তার বক্তব্যের প্রতিটি বিষয়টি সঠিভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন এবং তাদের দলীয় অবস্থান সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করে যাবেন।
কিন্তু মাননীয় সভাপতি অতি প্রত্যাশায় আমরা হতাশ হয়েছি। তিনি দলীয় অবস্থানের সুবিধা নেওয়ার জন্য অসম্পূর্ণ সংজ্ঞায়ন করেছেন। আজকের বিতর্কের বিষয়ের সাথে তার বক্তব্য মারাত্মকভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ বিধায় বিপক্ষ দলের হয়েও অসঙ্গতিপূর্ণ অংশের সঠিক সংজ্ঞায়ন করছি। এক্ষেত্রে সন্তানের মানসিকতা বলতে আমরা বুঝাচ্ছি তার ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণাকে যা সম্পূর্ণভাবে নিছক একটি আপেক্ষিক বিষয় এবং মূল কারণ বলতে বুঝাচ্ছি অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধান কারণকে।
এ পর্যায়ে পক্ষ দলের বিরোধিতায় আমাদের তুলে ধরতে হচ্ছে সন্তানের সুশিক্ষার অভােই মূলত বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ। আমরা তা প্রমাণে পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক শিক্ষার মতো চারটি প্রধান ক্ষেত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করছি। পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব, সন্তানের সামাজিকীকরণে ঘাটতি, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব এবং ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে অপসংস্কৃতি চর্চার মূল পিতা-মাতাকে অবহেলা করার মূল কারণ, সন্তানের মানসিকতা নয় । পক্ষ দলের প্রথম বক্তা বলেছেন সন্তানেরা পিতা-মাতার সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন পরবর্তীতে সেই সন্তানেরা পিতা-মাতার প্রতি দূর্ব্যবহার করেন। মাননীয় সভাপতি লক্ষ করুন এক্ষেত্রে সন্তানের মানসিকতা নয় বরং পারিবারিক সুশিক্ষা এবং সামাজিক অবকাঠামো এর জন্য মূল দায়ী।
সন্তানদের সু-শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভাব যখন পরিলক্ষিত হয় ঠিক তখনই সন্তানেরা তার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা করে থাকে। বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ দল অতীতের দিকে নজর দিন যেখানে একটি শক্তিশালী সামাজিক কাঠামোয় পরিবারের প্রতিটি সদস্য ছিল একই বৃত্তে সাদা ফুলের পাপড়ির মতো, যেখানে পিতা-মাতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো সন্তানের জীবন চক্রের প্রতি পর্যায়।
মাননীয় সভাপতি হতাশার চিত্র ঠিক তখনই দেখা যায় যখন এই পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবেই অমাবস্যার মতো অন্ধকার নেমে আসে বৃদ্ধ পিতা-মাতার জীবনে। মাননীয় সভাপতি, মিলবন্ধনের প্রভাবের কারণেই সন্তানরা বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে। তথ্যচিত্র লাইভ শিরোনামে ব্রাক কর্তৃক পরিচালিত একটি পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে বর্তমানে বাংলাদেশের ২৮ শতাংশ পরিবার হচ্ছে যৌথ পরিবার এবং 72 শতাংশ পরিবার।
নগরায়ন, কর্মসংস্থানের যোগান এবং সামাজিক বিলাসিতার প্রভাবে ধীরে ধীরে এই একক পরিবারের সংখ্যা বহুলাংশে বেড়েই চলেছে, যখন নিজের সন্তান রেখে সেই সাথে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ফেলে রেখে সন্তানের বাবা-মা নতুন আরেকটি পরিবার গঠন করছে তখন স্বাভাবিকভাবেই সন্তানেরা সেই শিক্ষাটাই গ্রহণ করছে এবং পরবর্তীতে সন্তানরাও পিতা-মাতার ছত্রছায়া ত্যাগ করে একক পরিবার গঠন করছেন। ওই সকল একক পরিবারের ক্ষেত্রে আবার ৬৭% পরিবারের বাবা-মা উভয়ই কর্মজীবী, তাদের সন্তানদের ৪৩ শতাংশ বেড়ে উঠছে পিতা-মাতার অধীনে এবং বাকিদের বেড়ে ওঠা নির্ভর করছে বাড়ির কাজের মেয়েদের ওপর। তথ্য সূত্র- www.bdsm.com।
যখন একটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে পারিবারিক মিলবন্ধন থাকে না, যখন তাদের কাছে কোনো রকম কোনো দায়বদ্ধতা কাজ করেনা তখন স্বাভাবিকভাবে সুশিক্ষার অভাবেই সন্তানরা তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে থাকে।
তাই পরিশেষে বলব, বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ সন্তানের মানসিকতা নয়, সুশিক্ষার অভাবই মূল কারণ। ধন্যবাদ মাননীয় সভাপতি, ধন্যবাদ সবাইকে।
পক্ষ দল- দ্বিতীয় বিতার্কিক: ইসরাত জাহান।
ধন্যবাদ মাননীয় সভাপতিকে আমাকে বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য, আমার দলের প্রথম বক্তা যখন অবহেলাকে সংজ্ঞায়িত করে গেলেন তখন প্রতিপক্ষের প্রথম বক্তা বিতর্কের এই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ঠিকই কিন্তু মন হয়তো ছিল অন্য কোথাও। তাই তিনি বারবার ভিন্ন ভিন্ন সুরে একই গান গেয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে গেলেন যে সন্তানের মানসিকতা নাকি বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ নয়, অবহেলা হচ্ছে প্রদত্ত পরিস্থিতিতে যত্নের অভাবে এবং ইচ্ছাকৃত অসতর্কতা অর্থাৎ বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ অবহেলার প্রশ্ন আসে তখনই যখন আপনি পূর্ণ সামর্থ্য থাকার সত্ত্বেও আপনি বৃদ্ধ পিতা-মাতার যত্নের প্রতি ছিলেন উদাসীন।
যে শুধুমাত্র টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না, শত চেষ্টা করেও পারছে না সে তো পরিস্থিতির শিকার। এক্ষেত্রে অবহেলার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে পূর্ণ সামর্থ্য থাকার সত্তেও যদি আপনি তাদেরকে করেন উপেক্ষা তখনই তাকে আমরা বলব অবহেলা যা আপনার মানসিকতার সমস্যা।
“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে” অন্তরের এই নিবেদন পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের অথচ সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে একটুখানি অবসর পেলেই যেখানে আমাদের ফেসবুক বা হিন্দি সিরিয়ালে ডুব দেয়ার সময় হয়, সেখানে ফোন দিয়ে বাবা-মাকে একটিবার জিজ্ঞেস করার সময় হয়না মা ভালো আছে কিনা বাবাকে জিজ্ঞেস করার সময় পর্যন্ত হয় না ওষুধ গুলা ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা, এখানে দোষটা কিন্তু বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিন্দি সিরিয়াল বা সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকের নয়, সমস্যা হচ্ছে আপনার মানসিকতার-বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ। একজন সুস্থ মানুষ সর্বোচ্চ 45 ডেল একক পর্যন্ত ব্যথার সম্মুখীন হতে পারে। আর সন্তান জন্মদানের সময় আমাদের মায়েরা যে পরিমাণ ব্যথার সম্মুখীন হন তা 57 ডেলের কিছু বেশি। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের প্রয়োগ করা হলে অনায়াসে তার ২০টি হাড় ভেঙে যাবে। সন্তানের জন্যই তা মায়ের সর্বোচ্চ বিসর্জন।
সন্তান হয়ে যেন মায়ের প্রতি আমাদের নিষ্ঠুর আচরণ। আর এর পেছনে মানসিকতাই যদি দায়ী না হবে তাহলে কেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা শাসনগাঁও এলাকায় ভরণপোষণ থেকে বাঁচতে সন্তানদের দ্বারা বস্তাবন্দি অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যাওয়া ৮0 বছর বয়সী বৃদ্ধা হাসিনা বেগম সেদিন মারা গেলেন? কেন জামির উদ্দিন শেখ নামের শতবর্ষী বাবা-ছেলের চারজনের হাতে মার খেয়ে আজ শয্যাশায়ী? তথ্য সূত্র দৈনিক প্রথম আলো ১৩ জুলাই ২০১৮। পত্রিকায় প্রকাশিত এমন হাজারো হতভাগ্য হাসিনা বেগম বা জামির উদ্দিন শেখ এর গল্প আপনাদের শোনাতে পারি জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল।
বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল সন্তানের ভিন্ন মানসিকতার কাছে এরপর কি সন্তানের সে পঁচে যাওয়া মানসিকতার চেয়ে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার অজুহাত কেই বড় করে দেখবেন? প্রশ্ন রইলে বিজ্ঞ বিপক্ষ দলের কাছে। প্রতিপক্ষ দল বলে গেলেন যে, সন্তানেরা নাকি এখন সময় পাচ্ছ না তার বাবা-মায়ের সাথে ব্যয় করার জন্য অর্থাৎ ব্যস্ততার কারণে তারা সময় দিতে পারছেন না তাদের বাবা-মাকে। আসলে সত্যি কথা বলতে জানেন কি, এই পৃথিবীতে সময়ের অভাব বলে কিছু নেই সব কিছুই নির্ভর করে আপনার প্রাধান্যের উপর । তাই দিনশেষে আপনার প্রাধান্য যদি পিতা-মাতা না হয় হয় ডিক্সডি প্লাস বা নেটফ্লিক্স তাহলে আঙ্গুল তো উঠবেই মানসিকতার দিকে।
মাননীয় সভাপতি প্রতিপক্ষের প্রথম বক্তার বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে তারা মানসিকতা নয় বরং সন্তানের সুশিক্ষার অভাবকেই দায়ী করে গেলেন যার কারণে প্রভাবিত হচ্ছে মানসিকতা। মাননীয় সভাপতি, কোন কিছুই তো আপনা আপনি হয় না এখন কেউ যদি ধূমপান করে বলে যে সিগারেটের নিকোটিনের কারণে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, এখানে ধূমপানের কোনো দোষ নেই, তাহলে বিষয়টিকে নিতান্তই হাস্যকর নয় কি? বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ তাই আজ বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক আপনারা কিন্তু বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের অবহেলার মূল কারণ হিসেবে সে মানসিকতাকে দায়ী করে গেলেন। ধন্যবাদ আমাদের সাথে একমত পোষণ করার জন্য।
প্রতিপক্ষের প্রথম বক্তা বলেছেন সমাজে বাবা-মায়ের মধ্যকার অশান্তি, ঝগড়া ইত্যাদি দেখে যে সন্তান বড় হয় সেতো পিতা-মাতাকে অবহেলা করবেই কিন্তু বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ একই পরিবারে বেড়ে ওঠা দুটি সন্তানের মধ্যে যখন এক ভাই হয় সমাজে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত আরেক ভাই হয় মাদকাসক্ত বেকার তখন আপনি কি বলতে চাইছেন যে তাদের বাবা-মা তাদের দু’রকম শিক্ষা দিয়েছেন?
অর্থাৎ আমি এটাই বোঝাতে চাচ্ছি যে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন ভালো মন্দের বিচার করার মানসিকতা বা বিবেকই দায়ী। বিরোধী পক্ষ আপনারা যখন এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি অবহেলার বিভিন্ন কারণ হিসেবে নানা অজুহাত টেনে আনতে ব্যস্ত, তখন সব কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মন্তাজ মিয়া নামের একজন দরিদ্র রিকশাচালক সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন বৃদ্ধকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে নিজের বাবার মত যত্ন আত্তি করছেন গত পাঁচ বছর ধরে।
রিকশা চালক মন্তাজ মিয়ার এই ঘটনা হানিফ সংকেতের ইত্যাদি অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছিল যেখানে অনেক উচ্চশিক্ষিত সচ্ছল ছেলেমেয়েরা অবহেলায় নিজের পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেখানে মমতাজ একজন দরিদ্র রিকশাচালক হয়েও এমন একটি মহৎ কাজ কি করে করতে পারলেন? তার তো ছিলনা অর্থবিত্ত, শিক্ষা কিংবা উচ্চ সামাজিক অবস্থান। কিন্তু তবুও তিনি তা পেরেছিলেন কারণ তার ছিল একটি উন্নত মানসিকতা যা বর্তমান সময়ে অপ্রতুল।
শেষ করার আগে মনে করিয়ে দিতে চাই দূরত্ব, সময়ের অভাব, কাজের চাপ, সুশিক্ষার অভাব ইত্যাদি বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কিছু দেয়াল মাত্র, আমাদের মানসিকতাকে বদলাতে হবে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। যদি কোনো কারণে কমতি হয় বা সন্তান অসমর্থ হয় সে ক্ষেত্রে আপনাদের দ্বারা দেখানো যুক্তিগুলো হয়তোবা একটি কারণ কিন্তু বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যদি কোনো কারণে অবহেলা করা হয় সেটা অবশ্যই সন্তানের মানসিকতারই সমস্যা।
বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ বাধ্যক্য মানে অসহায়ত্ব, একাকীত্ব, মৃত্যুভয় আর হাজারো রোগব্যাধির আনাগোনা। জীবনের যে সময়টায় আমাদের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ বাবা-মায়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় আমাদের। তখন কেন আমরা আমাদের মানসিকতাকে কবর দিয়ে দূরে ঠেলে দিব তাদের? তাই বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ, আসুন আমরা আমাদের মানসিকতাকে বদলায় জীবনের বিনিময়ে হলেও যারা সন্তানের প্রতি ভালোবাসার এতোটুকু কমতি হতে দেন না, সে পিতা-মাতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেষ করছি।
বিপক্ষ দল-দ্বিতীয় বিতার্কিক-তাসমিয়া জাহান মিম।
আহ্বান জানাচ্ছি বিপক্ষ দলের চট্টগ্রাম আইডিয়্যাল স্কুল এন্ড কলেজের দ্বিতীয় বক্তা তাসমিয়া জাহান মিমকে। ”বাবা আদর ভালোবাসা নিও, অনেক দিন হলো দেখি না তোমায়, আমার খুব কষ্ট হয় এ চার দেয়ালে বন্দী থাকতে, আমাকে মা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা হতো তোমার, আর তাইতো আজ আমার জায়গা হলো বৃদ্ধাশ্রমে।” তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার শেষ একটাই ইচ্ছে রেখো আমার মৃত্যুর খবর পেলে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। পড়ছিলাম 10-5-2019 বিশ্ব মা দিবসে দৈনিক কালের কন্ঠ প্রকাশিত ৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা মায়ের চিঠি। ৬ বছর কেটে গেল তার বৃদ্ধাশ্রমে।
মাননীয় সভাপতি, এমন অসংখ্য পিতা-মাতা নিজের সন্তানদের অবহেলার শিকার হয়ে চলে যেতে হলো বৃদ্ধাশ্রমে, এই চিত্রটি দেখতে হচ্ছে তার মূল কারণ সন্তানদের সুশিক্ষার অভাব। ধন্যবাদ মাননীয় সভাপতিকে আমাকে বিতর্কে সুযোগ দেওয়ার জন্য। বিতর্কের বিষয় নির্ধারিত হয়েছে “বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ সন্তানের মানসিকতা।” বিপক্ষে প্রতিপক্ষ দলের প্রথম ও দ্বিতীয় বক্তা ১০ মিনিটের বক্তব্য শুনে আমার মনে হলো বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ হিসেবে সন্তানের মানসিকতাকে প্রমাণ করতে গিয়ে তারা নিজেরাই মানসিক চাপে ভুগছে যে কারণে তারা সঠিক কারণ অনুসন্ধান না করে তাদের দলীয় অবস্থান কে সম্পূর্ণ দুর্বল প্রতিমান করেছেন।
প্রতিপক্ষ দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আমি কিছুক্ষণের জন্য আপনাদের দলের একজন নিরন্তক সমর্থক, এবং আমিও পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অবহেলার কারণ হিসেবে মানসিকতাকেই দায়ী করছি কিন্তু মাননীয় সভাপতি প্রতিটি বিতর্ক ম্যাচের ফলাফল সুনির্দিষ্ট একটি সমাধানের পথ বলে দেয় এবং আজকেও আমরা সুনির্দিষ্ট একটি ফলাফলের পথে এগিয়ে যেতে চাই। ঠিক তখনই প্রশ্ন ওঠে আজকে পিতা-মাতার প্রতি অবহেলার জায়গাটি থেকে সন্তানদের বের করে আনার জন্য কোন অভাব পূরণ করা অতীব প্রয়োজন আছে। তখনই সমর্থনের জায়গা থেকে যদি আমরা মানসিকতার অভাব পূরণ করতে চাই তাহলে এখানে উপস্থিত সকলেই সুশিক্ষার অভাব কে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরবে। সভাপতি যখন পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার সমস্যা সমাধানে আমাদের দেখিয়ে দেওয়া সুশিক্ষায় হয় এর মূল উপকরণ তখন একথা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয় যে মানসিকতা নয় বরং সুশিক্ষার অভাব এই বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ।
এটি প্রতিপক্ষ দলের দ্বিতীয় পক্ষের যুক্তি আর কোন রকম দৃঢ়তা থাকেনা। মাননীয় সভাপতি আমাদের প্রথম বক্তার উপস্থাপিত দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি অর্থাৎ সন্তানের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের অভাবে বৃদ্ধ পিতা- মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের অবহেলার কারণটি ব্যাখ্যা করছি। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী-কিংসলে ডেবিটের মতে সামাজিকীকরণ এমন একটি মাধ্যম যার মাধ্যমে মানব শিশু ক্রমশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষে পরিণত হয় এবং এ প্রক্রিয়া ছাড়া ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব লাভে ব্যর্থ হয়। সমাজের একজন যোগ্য উপযুক্ত
নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। অথচ মাননীয় সভাপতি আমাদের সামাজিকীকরণের চিত্রে এখন দেখতে পাওয়া যায় একভিন্ন অপহন। দূরন্তপনা শিশু-কিশোরদের ছুটে চলা মাঠের পর মাঠ, ডাংগুলি লাটিম কিংবা দাঁড় বেয়ে নৌকা চালানো, স্কুলের সময় হলে স্কুলে যাওয়ার চিত্র। সেখানে এখন দেখা যায় নগরায়নের আধুনিকতায় কিশোর গ্যাং কালচার, মাদকাসক্তি, ইভটিজিং এর চিত্র। তথ্যচিত্র তুলে ধরছি ২০১৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৩৬ লক্ষ। এর মধ্যে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৩৫ লক্ষ ৩৫ হাজার ৩০০। তথ্যসূত্র – মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট।
মাননীয় সভাপতি, যখন একজন মানুষ মাদকাসক্ত ফলে নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেলে, তবে সে কিভাবে তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিবে। মাননীয় সভাপতি লক্ষ করুন, বর্তমানে বেশিরভাগ পরিবারে বাবা ব্যাস্ত ল্যাপটপে, মা সিরিয়ালে, সন্তান মোবাইল ফোনে আমরা গ্রহণ করছি যান্ত্রিকতা। এ কারণে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারের সাথে দূরত্ব বাড়ছে তার পিতা-মাতার। তথ্যসূত্র- dgfp.gov.bd ।
যেখানে ল্যাপটপ ছাড়া পিতা আশা করা যায় না, সিরিয়াল ছাড়া মা আশা করা যায় না সেখানে কীভাবে সন্তানেরা তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিবে ? সে প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমি জানিনা কিভাবে পক্ষ দল শুধুমাত্র সন্তানের মানসিকতাকে বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট যুক্তি প্রতিপক্ষ দলের থেকে আশা করছি।
এখন আরো একটি অধ্যায় নিয়ে কথা বলি যেখানে সামাজিক শ্রেণি, বৈষম্য ও বিলাসিতা যোগ করছি। বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে এটি অবহেলার এক নতুন মাত্রা। একজন মানুষ যখন দেখে তার প্রতিবেশীর বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি তখন তারা অসুস্থ পিতা-মাতার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে না হলে সেও কিন্তু তার প্রতিবেশীর সাথে পাল্লা দিয়ে বিলাসিতার এই প্রতিযোগিতায় জিততে পারত। আবার বিলাসিতা ও আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় যেতে চাও সন্তান যখন দেখে তার আধিপত্য জীবনের সবচেয়ে সেকেলে তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা আর তখনই আসে বিপত্তি। মাননীয় সভাপতি, মানবতার প্রাচীর ভেঙে যখন বিলাসিতার মজবুত দেয়ালে আটকে যায় সন্তানের সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সামাজিক সুশিক্ষার অভাব অভাবনীয়ভাবে অবক্ষয়ের কারণ এই বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা অবহেলিত অর্থাৎ এক্ষেত্রে সামাজিকভাবে সন্তানকে সুশিক্ষা প্রদান এবং শিক্ষা গ্রহণের অভাবই মূল কারণ। ধন্যবাদ মাননীয় সভাপতি, ধন্যবাদ সবাইকে।