তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহনের যুগে বিশ্ব আমেরিকার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নতুন ইতিহাস।
৯ কিলোমিটার দূরে সফলভাবে বিদ্যুৎ পাঠানোর বিস্ময়কর সাফল্য
বিশ্বের প্রযুক্তির অগ্রগতিতে আবারো নতুন এক মাইলফলক যুক্ত হলো। এবার তার ছাড়াই দূরপাল্লায় বিদ্যুৎ পরিবহনের কল্পনা বাস্তবে রূপ পেল। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা সংস্থা অবিশ্বাস্য এক সাফল্যের মাধ্যমে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে তারবিহীন বিদ্যুৎ পাঠিয়ে প্রযুক্তি জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার স্মার্ট সিটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং সামরিক প্রযুক্তিতে অসীম সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
বিদ্যুতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়
বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে মানবসভ্যতা এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল। তবে যুগে যুগে বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য নির্ভর করতে হয়েছে তারের উপর। দীর্ঘদিন ধরেই তারবিহীন বিদ্যুৎ পাঠানোর স্বপ্ন বিজ্ঞানীদের মনে ছিল, কিন্তু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে তা অধরা ছিল। অবশেষে আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে সেই স্বপ্ন এবার বাস্তব রূপ পেল।
নিকোলা টেসলার স্বপ্নের বাস্তবায়ন
১৯ শতকে নিকোলা টেসলা প্রথমবারের মতো তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহনের ধারণা তুলে ধরেছিলেন। টেসলা কয়েল এবং ওয়ার্ডেন ক্লাইফ টাওয়ারের মাধ্যমে তিনি দূর থেকে বিদ্যুৎ পাঠানোর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়ের প্রযুক্তি ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তার স্বপ্ন সফল হয়নি।
আজ সেই অসমাপ্ত কাজের উত্তরসূরি হিসেবে আধুনিক গবেষকরা এগিয়ে এসেছেন এবং প্রমাণ করেছেন — বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য তারের প্রয়োজন নেই।
ডারপার (DARPA) অভূতপূর্ব সাফল্য
যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি (ডারপা) আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ‘পারসিস্ট্যান্ট অপটিক্যাল ওয়্যারলেস এনার্জি রিলে’ (পাওয়ার) প্রকল্পের আওতায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে।
২০২৫ সালের মে মাসে, ডারপা সফলভাবে লেজার প্রযুক্তির মাধ্যমে ৮.৬ কিলোমিটার দূরে ৮০০ ওয়াটের বেশি শক্তি পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের পরীক্ষায় এক মেগাজুলেরও বেশি শক্তি স্থানান্তর করে তারা বিদ্যুৎ পরিবহনের আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে।
পরীক্ষাটি আরো আকর্ষণীয় করতে তারা পাঠানো শক্তির সাহায্যে দূর থেকে পপকর্ন তৈরি করে দেখিয়েছে, যা এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা ও নির্ভুলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
লেজার প্রযুক্তির চমক
এই বিপ্লবী প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হলো লেজার বা অপটিক্যাল বিম। এতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লেজার রশ্মির মাধ্যমে বিদ্যুৎকে আলোর আকারে পাঠানো হয়। দূরবর্তী গ্রাহক প্রান্তে ফটোভোল্টেইক সেল বা অনুরূপ ডিভাইসের মাধ্যমে আলোকে আবার বিদ্যুতে রূপান্তর করা হয়।
এই প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ ভবিষ্যতে ড্রোন, মহাকাশ যান, স্যাটেলাইট এবং দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের নতুন সুযোগ এনে দিতে পারে। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্র বা জরুরি পরিস্থিতিতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে তার ছাড়াই।
নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
তবে প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চক্ষমতার লেজার রশ্মি যদি ভুল লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, তবে তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই এই প্রযুক্তি ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং উন্নত টার্গেটিং সিস্টেম ও নিরাপত্তা প্রটোকল নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্যিকভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে এখনো ব্যাপক গবেষণা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন রয়েছে।
তারবিহীন বিদ্যুতের দিকে অগ্রসর বিশ্ব
এই সফলতা প্রমাণ করে — বিদ্যুৎ পরিবহনে আমরা এক নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে। ভবিষ্যতে তারবিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ স্মার্ট সিটি গড়ে তোলা, পরিবেশবান্ধব শক্তির ব্যবহার এবং দুর্গম অঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার জন্য অমূল্য ভূমিকা রাখবে।
বিশ্ব এখন অপেক্ষা করছে, কখন এই প্রযুক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার শুরু হবে। অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো আমরা দেখতে পাবো তারবিহীন বিদ্যুৎ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, এক নতুন বৈপ্লবিক সময়ের সূচনা করছে।